শীতে শিশুর যত্নে কার্যকরী কিছু টিপস
শীতকাল অনেকের জন্য পছন্দের হলেও ছোট শিশুদের জন্য হতে পারে একটু কষ্টকর। শীতের শুষ্ক আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার ওঠানামা শিশুর ত্বক, শ্বাসযন্ত্র এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শীতে শিশুদের সঠিক যত্ন নেওয়া উচিত। অনেক বাবা-মা শিশুর শীতকালীন যত্ন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। তাই এই ব্লগ পোস্টে, আমরা শীতকালে শিশুর যত্ন নিয়ে কার্যকরী কিছু টিপস আলোচনা করব।
শীতকালে শিশুরা ঠাণ্ডাজনিত অসুখ যেমন সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের শুষ্কতা এবং ঠোঁট ফাটার মতো সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। তবে সঠিক যত্ন এবং কিছু কার্যকরী টিপস অনুসরণ করে শিশুর স্বাস্থ্য এবং আরাম নিশ্চিত করা সম্ভব।
শীতে শিশুর যত্নে কী কী বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত এবং কিভাবে তাদের ছোটখাটো অসুখ দূরে রাখা যায়, এই পোস্টে তা বিস্তারিতভাবে জানানো হবে। যারা প্রথমবার বাবা-মা হয়েছেন, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে, কারণ এসব সহজ পদক্ষেপ আপনার শিশুকে শীতের ঠাণ্ডা থেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
শীতে নবজাতকের যত্ন করণীয় ও পরিচর্যা
নিয়মিত যত্নের মাধ্যমে শীতে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই অংশে আমরা শীতে নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় পরিচর্যার কিছু কার্যকরী পরামর্শ ও করণীয় বিস্তারিত আলোচনা করব।
শীতকালে বাচ্চাদের ত্বকের যত্ন
শীতকালে শিশুর ত্বক খুব দ্রুত শুষ্ক হয়ে যায়। এই শুষ্কতার কারণে শিশুরা ত্বকের চুলকানি ও অস্বস্তিতে ভোগে। তাই, শীতে শিশুর ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারেন।
ত্বক আর্দ্র রাখাঃ শীতকালে শিশুর ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় বলে প্রতিদিন শিশুর ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। এক্ষেত্রে শিশুর জন্য বিশেষভাবে তৈরি বিভিন্ন বেবি কেয়ার প্রডাক্ট যেমনঃ ময়েশ্চারাইজার ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। শীতে বাচ্চাদের জন্য ক্রিম ব্যবহার করলে তাদের ত্বক দীর্ঘ সময় আর্দ্র থাকে এবং শুষ্কতা থেকে রক্ষা পায়।
নিয়মিত তেল মালিশঃ শীতের সময় শিশুর ত্বকের সুরক্ষায় তেল মালিশ খুবই কার্যকরী। ঘরোয়া তেল যেমন নারিকেল তেল, অলিভ অয়েল বা বাদামের তেল দিয়ে প্রতিদিন ত্বকে আলতো করে মালিশ করলে ত্বকের আদ্রতা বজায় থাকে।
শীত উপযোগী সাবান ও শ্যাম্পুঃ শীতে শিশুর ত্বক শুষ্ক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাই এমন সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত যা প্রাকৃতিক উপাদানযুক্ত। এসব সাবান ও শ্যাম্পু ত্বকের প্রাকৃতিক তেলকে বজায় রাখে এবং শুষ্কতা রোধে সহায়তা করে।
ঠোঁট ও নাকের যত্নঃ শীতে শিশুর ঠোঁট ও নাক ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঠোঁট ফাটা এড়াতে শিশুর ঠোঁটে শিশুদের জন্য বিশেষ লিপ বাম ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, নাকের শুষ্কতা থেকে রক্ষা পেতে ন্যাজাল ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন, যা শিশুর শ্বাস নিতেও সুবিধা দিবে।
শিশুর নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
শীতের সময় নবজাতকের পরিচ্ছন্নতার প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি অবশ্যই হতে হবে সুরক্ষিত এবং আরামদায়ক পদ্ধতিতে। শিশুর শরীর বারবার ভেজা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। তাই নরম, শুষ্ক কাপড় বা টিস্যু ব্যবহার করা উচিত।
গোসলের ক্ষেত্রে খুব গরম পানি নবজাতকের ত্বকের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়, তাই হালকা গরম পানিতে অল্প সময় ধরে গোসল করানো ভালো। সপ্তাহে ২-৩ বার হালকা গরম পানিতে গোসল করানো যথেষ্ট।
শীতে বাচ্চাদের সঠিক পোশাক নির্বাচন
শীতকালে শিশুর আরাম ও উষ্ণতা বজায় রাখতে সঠিক পোশাক নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে তীব্র শীত থেকে রক্ষা দিবে আবার একইসাথে শিশুর জন্য আরামদায়ক হবে এমন পোশাক বাছাই করুন।
লেয়ারিং বা স্তরে পোশাক পরিধানঃ শিশুকে একাধিক স্তরে পোশাক পরান, যা লেয়ারিং নামে পরিচিত। এতে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। এমনভাবে পোশাক পরান যাতে আপনি সহজেই লেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে বা কমাতে পারেন।
মোজা, টুপি ও গ্লাভস ব্যবহারঃ শিশুর মাথা, পা ও হাত ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করতে মোজা, টুপি ও গ্লাভস ব্যবহার করুন। মাথা থেকে তাপমাত্রা দ্রুত বের হয়ে যায়, তাই টুপি পরানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, পা ও হাত গরম রাখতে মোজা ও গ্লাভস ব্যবহারে শিশুরা আরাম পায়।
নরম ও আরামদায়ক পোশাকঃ শীতে নবজাতক অথবা নিউবর্ন বেবি উলজাতীয় পোশাকে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। এজন্য আরামদায়ক ও সুতির পোশাক ব্যবহার করুন। এটি শিশুর ত্বকে কোনো অস্বস্তি তৈরি করবে না।
ঘরের পরিবেশ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
ঘর খুব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে শিশু নানাবিধ কষ্ট অনুভব করবে। তাই ঘরে হিটার বা অন্যান্য গরম করার যন্ত্র ব্যবহার করে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখুন। শীতকালে জানালা বা দরজা বন্ধ করে রাখা হলেও কিছু সময় পরপর ঘরের দরজা-জানালা খুলে একটু বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। এতে ঘরের মধ্যে সতেজ বায়ু প্রবেশ করে এবং জীবাণু দূর হয়।
শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ঘরের আর্দ্রতা কমে যায়। এটি শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ঘরের আর্দ্রতা বজায় রাখতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন। অথবা আপনার শিশুকে সকালে একটু রোদে নিয়ে যেতে পারেন। ত্বকে রোদ পড়লেই সেটি থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হয় আর সুস্থতার জন্য ভিটামিন ডি অপরিহার্য।
শীতে বাচ্চাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা
শীতের শুষ্ক ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এবং শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্য তাদের খাদ্যে কিছু বিশেষ পুষ্টিকর উপাদান সংযোজন করা উচিত। নিচে কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
পর্যাপ্ত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার
শীতকালে সঠিক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বাচ্চাদের শরীরকে মজবুত করে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- মাছ ও মাংস
- ডিম
- ডাল ও লেগুম
- পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার
শীতকালে শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন এবং মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার খুবই প্রয়োজনীয়। নিম্নের খাবারগুলোতে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে।
- ফল
- সবজি
- বেদানা
- সাইট্রাস ফল
- মিষ্টি কুমড়া
- গাজর
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
শীতকালে শিশুদের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ, দই ও পনির খাওয়ানো যেতে পারে। হালকা গরম দুধ শীতকালে শরীরের জন্য আরামদায়ক এবং সহজে হজম হয়।
এর পাশাপাশি আপনার বাচ্চাকে মিষ্টি দই বা গরম দুধের সঙ্গে সামান্য মধু মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। এছাড়াও অল্প পরিমাণে পনির শিশুদের জন্য প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে সহায়ক।
শক্তি সরবরাহকারী শস্যজাতীয় খাবার
শীতের দিনে শক্তি সরবরাহের জন্য শস্যজাতীয় খাবার জরুরি। এ জাতীয় খাবার শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও কার্বোহাইড্রেট যোগায়। শস্যজাতীয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- খিচুড়ি
- ওটমিল
- নরম রুটি
- চিড়া
- শুকনো ফল ও বাদাম
শুকনো ফল এবং বাদাম শিশুরা সহজেই খেতে পারে, এবং এতে থাকে প্রয়োজনীয় ফ্যাট, যা শরীরকে শীতের সময় উষ্ণ রাখে। এই খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- আমন্ড
- কাজু
- কিশমিশ
- খেজুর
- চিয়া সিড
- পর্যাপ্ত পানি ও গরম পানীয়
শীতকালে শিশুরা কম পানি পান করে, কিন্তু শরীরের সঠিক হাইড্রেশন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই শিশুকে নিয়মিত পানি পান করানোর পাশাপাশি গরম পানিও দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও আপনার শিশুকে গরম পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে দিতে পারেন। লেবুতে থাকা ভিটামিন সি শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
শীতকালে শিশুর রোগ প্রতিরোধে করণীয়
শীতকালে শিশুর সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমনঃ
ভ্যাকসিন ও নিয়মিত চিকিৎসা
শীতকালে ঠাণ্ডা, কাশি, এবং ফ্লু থেকে রক্ষা পেতে শিশুকে নির্দিষ্ট সময়ে ভ্যাকসিন দিন। এছাড়াও, প্রয়োজনীয় টিকা এবং ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
হাত ধোয়ার অভ্যাস
শীতকালে শিশুকে বাইরে থেকে ঘরে আসার পর হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি জীবাণু সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে এবং ঠাণ্ডা ও কাশির ঝুঁকি কমায়।
ঠাণ্ডা-কাশি হলে করণীয়
যদি শিশুর ঠাণ্ডা-কাশি হয় তবে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে তাকে গরম পানির ভাপ দিতে পারেন। এছাড়াও, শিশুর শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তার দেখান এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিন।
বহিরাগতদের আসা কমানো
নবজাতকের আশেপাশের পরিবেশ সবসময় পরিষ্কার রাখুন। শিশুর সংস্পর্শে আসার আগে হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত। এছাড়াও শীতকালে নবজাতকের সংস্পর্শে খুব বেশি মানুষকে আনা এড়িয়ে চলুন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে।
পর্যাপ্ত ঘুমানো
শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বৃদ্ধি করে। কিন্তু শীতে ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও শুষ্ক বাতাস শিশুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই শিশুর পর্যাপ্ত ঘুমানো নিশ্চিত করতে উষ্ণ বিছানা প্রস্তুত করে তাকে আরামদায়ক পরিবেশের ব্যবস্থা করুন।
উপসংহার
শীতকালে শিশুর সুরক্ষা ও সুস্থতার জন্য প্রতিদিনের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরে শীতকালে শিশুর যত্ন বিষয়ক টিপসগুলো অনুসরণ করলে আপনার শিশুকে শীতের ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে রক্ষা করা এবং সুস্থ রাখা সহজ হবে। শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে ত্বকের যত্ন, সঠিক পোশাক নির্বাচন, খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা, এবং ঘরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।
রায়হান আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url